এয়ারটেল থেকে পাওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের ১১.৬ মেগাহার্জ তরঙ্গ এবং ‘০১৬’ দিয়ে শুরু নম্বর নিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে রয়েছে মোবাইল অপারেটর রবি আজিয়াটা লিমিটেড। রবির অনুকূলে থাকা এয়ারটেলের ৯০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের ১.৬ মেগাহার্জ এবং ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের ১০ মেগাহার্জ—মোট ১১.৬ মেগাহার্জ তরঙ্গের ১৫ বছরের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৯ ডিসেম্বর।
রবি কম মূল্যে এই তরঙ্গের মেয়াদ নবায়ন করতে আগ্রহী। কিন্তু দেশের বেসরকারি অন্য মোবাইল ফোন অপারেটররা এতে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, ওই তরঙ্গ রবিকে কম মূল্যে ব্যবহারের অনুমতি দিলে তার সঙ্গে সমন্বয় করে ২০১৮ সালে কেনা তাদের তরঙ্গের দামও কমিয়ে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দিতে হবে। অথবা বিটিআরসি বা সরকারের কাছে থাকা অব্যবহূত তরঙ্গ একই মূল্যে তাদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে হবে। অন্যথায় তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করতে হবে। গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক এ বিষয়ে বিটিআরসির সঙ্গে বৈঠক করেছে এবং গত সপ্তাহে লিখিতভাবে তাদের মতামত জানিয়েছে।
গত বুধবার রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৬ সালে রবি আজিয়াটা লিমিটেডের সঙ্গে মার্জারের (একীভূত) পর কম্পানি হিসেবে এয়ারটেল বাংলাদেশ লিমিটেড আইনগতভাবে বিলুপ্ত। এয়ারটেল থেকে পাওয়া ১১ দশমিক ৬ মেগাহার্জ তরঙ্গের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হবে। এই তরঙ্গ পুনরায় ব্যবহারের (স্পেকট্রাম রিনিউয়াল) অনুমোদন চেয়ে রবি এরই মধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে আবেদন জমা দিয়েছে, যা এখন বিবেচনাধীন।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি সর্বশেষ ফোরজি সেবার জন্য তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করে। এতে রবি অংশ নেয়নি। বিটিআরসি সে সময় পৃথক তিনটি ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করে। গ্রামীণফোন আর বাংলালিংকের আগ্রহ ছিল শুধু দুটি ব্যান্ডে। যে তিনটি ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামের আয়োজন করা হয়, সেগুলো হলো ৯০০ মেগাহার্জ, ১৮০০ মেগাহার্জ ও ২১০০ মেগাহার্জ। ৯০০ ও ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গ নিলামের ক্ষেত্রে প্রতি মেগাহার্জের ভিত্তিমূল্য ছিল তিন কোটি মার্কিন ডলার। আর ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের তরঙ্গের ভিত্তিমূল্য ছিল প্রতি মেগাহার্জ দুই কোটি ৭০ লাখ ডলার। নিলামে প্রতিটি ব্যান্ডের অংশ নেওয়ার বিড আর্নেস্টমানি ছিল ১৫০ কোটি টাকা করে। গ্রামীণফোন শুধু ১৮০০ মেগাহার্জ এবং বাংলালিংক ২১০০ মেগাহার্জ ও ১৮০০ মেগাহার্জ তরঙ্গ নিলামে অংশ নেয়।
বাংলালিংক এক হাজার ১১৯ কোটি টাকায় ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ড এবং এক হাজার ৪৩৯ কোটি টাকায় ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের মোট ১০ দশমিক ৬ মেগাহার্জ তরঙ্গ কিনে নেয়। আর গ্রামীণফোন এক হাজার ২৮৪ কোটি টাকায় কিনে নেয় ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের ৫ মেগাহার্জ তরঙ্গ। ওই নিলামে তরঙ্গের যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তার ভিত্তিতেই এয়ারটেলের এই ১১ দশমিক ৬ মেগাহার্জ তরঙ্গের মূল্য এখন ৩৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন হাজার ৪৩ কোটি টাকা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, রবি গত ৩ আগস্ট এই তরঙ্গের মেয়াদ নবায়ন করার জন্য আবেদন করে। গত ৯ আগস্ট এ বিষয়ে বিটিআরসির স্পেকট্রাম (তরঙ্গ) বিভাগের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে বিটিআরসির সঙ্গে রবির কর্মকর্তাদের একটি অনলাইন সভা হয়। এরপর ১২ আগস্ট বিটিআরসির সভায় এ বিষয়ে মতামত জানাতে সংস্থাটির বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালককে আহ্বায়ক করে মোট ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটিকে এই তরঙ্গ নবায়নের শর্ত ও মূল্য নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর বিষয়টি সম্পর্কে লিখিতভাবে তাদের মতামত জানায়।
গ্রামীণফোন বলছে, তরঙ্গের নবায়ন পদ্ধতিতে অবশ্যই স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে এবং সব অপারেটরকে এ বিষয়ে সুযোগ দিতে হবে। বিটিআরসিকে নবায়নের শর্ত ও মূল্য ঘোষণা করতে হবে এবং সব অপারেটরকে সেই শর্তাবলি অনুসারে নির্ধারিত মূল্যে তরঙ্গ নেওয়ার আগ্রহ দেখাতে বলতে হবে। রবির ক্ষেত্রে এটি নবায়ন এবং অতিরিক্ত তরঙ্গ হিসেবে গণ্য হবে। আর অন্যান্য অপারেটরের ক্ষেত্রে এটি হবে অতিরিক্ত তরঙ্গ। আর তরঙ্গের পরিমাণের চেয়ে চাহিদা যদি বেশি হয়, তাহলে নিলামের আয়োজন করতে হবে।
বাংললিংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, টেলিযোগাযোগ খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা বজায় রাখতে সরকারের উচিত সর্বশেষ নিলামের নির্ধারিত মূল্যে তরঙ্গ বিক্রি করা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি এখন স্বল্পমূল্যে তরঙ্গ বিক্রি করে, তাহলে বাংলালিংক আগের নিলামে যে অর্থ ব্যয় করেছে, তা থেকে একটি অংশ ফেরত চাইবে।
এদিকে বাংলালিংক তাদের চিঠিতে উল্লেখ করে, তরঙ্গ নবায়ন চেয়ে রবি আজিয়াটা বিটিআরসিকে যে চিঠি দিয়েছে তার অনুলিপি চেয়েও তারা পায়নি।
এয়ারটেলের ‘০১৬’ নম্বর নিয়ে বাড়তি জটিলতা : তরঙ্গ ছাড়াও এয়ারটেলের ‘০১৬’ দিয়ে শুরু নম্বর ব্যবহার নিয়ে বাড়তি জটিলতায় রয়েছে রবি। বিটিআরসির সাম্প্রতিক একটি সভায় বলা হয়, রবির সব পণ্য/সেবার ক্ষেত্রে নিজস্ব নামের পাশাপাশি এয়ারটেল নামেও বিজ্ঞাপন দেওয়া ও বাজারজাত করা তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত। এটি রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার শর্তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
বিটিআরসির এলএল (লিগ্যাল ও লাইসেন্সিং) বিভাগের মতামত হচ্ছে—রবি ও এয়ারটেলের একীভূত হওয়ার শর্ত শিথিল করার কোনো সুযোগ নেই। একীভূত হওয়ার বিষয়ে বিটিআরসির অনুমোদনপত্রের ১০ নম্বর শর্ত রবিকে পুরোপুরি পূরণ করতে হবে। এই শর্ত সরকার অনুমোদিত এবং এটি শিথিলের কোনো অবকাশ নেই। এ ছাড়া ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট এ বিষয়ে আদালতের রায়ও রয়েছে।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই গ্রাহকদের কাছে এয়ারটেলের ‘০১৬’ অপারেটর কোডের যত নম্বর আছে, তা রবির ‘০১৮’ কোডে স্থানান্তর করার কথা ছিল। রবি বিটিআরসির কাছে আবেদন করে ওই সময় গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়। সে সময় রবির আবেদনপত্রে যুক্তি দেখানো হয়, গ্রামীণফোনকে ০১৭সহ ০১৩ এবং বাংলালিংককে ০১৯সহ ০১৪ প্রিফিক্সের নম্বর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে রবির জন্য ‘০১৬’ প্রিফিক্সের নম্বর প্রয়োজন। বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রবি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য বিটিআরসির কাছে জরুরি ভিত্তিতে ‘০১৬০’ ও ‘০১৬৪’ ব্লক থেকে ২০ লাখ নম্বর বরাদ্দের জন্য আরেকটি আবেদন করে। সম্প্রতি রবি আবারও তাদের অনুকূলে ‘০১৬’ প্রিফিক্স ব্যবহারের সুযোগ অব্যাহত রাখার আবেদন জানিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে বিটিআরসি এখন সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বিটিআরসির মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী সচিব জাকির হোসেন খান গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এয়ারটেলের কাছ থেকে পাওয়া রবির ১১ দশমিক ৬ তরঙ্গ নবায়নের শর্ত ও মূল্য নির্ধারণে গঠিত কমিটি কাজ করছে। আগামী সপ্তাহে বিটিআরসির সভায় কমিটি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দিতে পারে।
‘০১৬’ প্রিফিক্স সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়েও বিটিআরসি আইনগত সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখছে। কোনো পক্ষ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’